Header Ads Widget

আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিন

জুলাই সনদের প্রয়োজনীয়তা নেই! একটি সাংবিধানিক ও বৈশ্বিক বিশ্লেষণ

  


বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এক নতুন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে  “জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫”। এ সনদের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধানিক কাঠামো গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে—যেখানে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, বিচার বিভাগের সংস্কার, নতুন নির্বাচন ব্যবস্থা ইত্যাদি সংযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সংবিধানের বাইরে গিয়ে একটি 'সনদ' প্রণয়ন আদৌ কি বৈধ বা প্রয়োজনীয়?

এই প্রবন্ধে আমরা বিচার করবো—এ সনদের সাংবিধানিক ভিত্তি, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আন্তর্জাতিক রেফারেন্স এবং জনগণের প্রকৃত চাহিদার নিরিখে—এই সনদের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা।

সংবিধানই সর্বোচ্চ আইন: আইনগত প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে ঘোষিত। সংবিধানের ধারা ৭(১) বলছে:

“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং সংবিধানই প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন।”

এছাড়া ধারা ৭(২) বলছে:

“এই সংবিধানের পরিপন্থী কোন আইন বাতিল এবং অকার্যকর গণ্য হবে।”

অর্থাৎ, যদি কোনো “সনদ” বা ঘোষণা সংবিধানের বাইরে যায়, তা আইনগতভাবে বাতিলযোগ্য এবং অসাংবিধানিক। তাই “জুলাই সনদ” সংবিধানের বাইরে গিয়ে সংবিধান পরিবর্তনের বা বিকল্প রূপরেখা তৈরির চেষ্টা করলে তা বেআইনি ও অসাংবিধানিক হবে।

ইতিহাস কী বলে: অভ্যুত্থান ও বিকল্প ঘোষণার ব্যর্থতা

বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা একাধিকবার দেখেছি—সংবিধান উপেক্ষা করে গঠিত ঘোষণাপত্র বা আদর্শিক সনদ কিভাবে গণতন্ত্র ধ্বংসের হাতিয়ার হয়েছে:

◾ ১৯৭৫-এর “জাতীয় পুনর্গঠনের সনদ”

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সামরিক প্রশাসন “জাতীয় পুনর্গঠনের লক্ষ্যে” সংবিধান সংশোধন করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এটি দেশের রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ধ্বংস করে।

◾ ১৯৮২-এর এরশাদের ‘নবউন্নয়ন’ ভাবনা

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ “নবউন্নয়ন নীতিমালা” নামে একটি বিকল্প নীতি চালু করেছিলেন। কিন্তু সেইসব নীতিমালা সংবিধানের বাইরে হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদে জনগণের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

◾ ২০০৭-০৮ তত্ত্বাবধায়ক সরকার

“বিকল্প রাজনৈতিক সংস্কার” এর নামে একটি অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতা দখল করে। এই সরকার ব্যর্থ হয়, কারণ এর কোনো গণতান্ত্রিক ভিত্তি ছিল না।

প্রতিবার সংবিধানের বাইরে গঠিত যেকোনো সনদই অস্থিরতা ও গণতন্ত্রের পেছনে ফেরা ডেকে এনেছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: বিশ্বজুড়ে সংবিধানই চূড়ান্ত

 জার্মানি: Grundgesetz

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি একটি সংবিধান প্রণয়ন করে যার নাম “Grundgesetz”। কোনো বিকল্প ঘোষণা নয়, বরং গণভোট ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি গৃহীত হয়। সংবিধান বিরোধী কিছু হলে তা “Verfassungswidrig” ঘোষণা করে আদালত বাতিল করে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র: Declaration vs. Constitution

১৭৭৬ সালের ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স ছিল একটি রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র। কিন্তু কার্যকর রাষ্ট্রগঠনের জন্য ১৭৮৭ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। আজ তা US Constitution—সবকিছুর মূল।

ফ্রান্স: Fifth Republic Constitution (1958)

ফ্রান্সেও বিপ্লব, অভ্যুত্থান ছিল। কিন্তু বর্তমানে সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট-নির্ভর সরকার চলে। বিকল্প ঘোষণা বা সমঝোতার কোনো জায়গা নেই।

কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানের বাইরের ‘সনদ’ চলমান আইনি কাঠামোর বিরোধিতা করে—এবং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বিপন্ন করে।


জুলাই সনদের অন্তঃসারশূন্যতা ও বৈধতা সংকট

জুলাই সনদ সাত দফার একটি রূপরেখা দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:

  • দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ
  • আপিল বিভাগের স্বতন্ত্র নিয়োগ পদ্ধতি
  • নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন
  • সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পূর্ণ ক্ষমতা
  • জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ
  • মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি নির্ধারণের আলাদা আইন

    এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু তা হতে হবে সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে, গণভোটের মাধ্যমে বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানে এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য নির্ধারিত পদ্ধতি রয়েছে (ধারা ১৪২)

    আসলে, এই সনদের নামেই স্পষ্ট—এটি রাষ্ট্রের কোনো কর্তৃত্বপূর্ণ জায়গা থেকে আসেনি। এটি কোনো গণভোটে পাশ হয়নি, কোনো আদালতের অনুমোদন নেই, এমনকি সংসদীয় সমর্থনও নেই।

    জনগণের সত্যিকারের চাহিদা কী?

    বাংলাদেশের মানুষ চায়:

    • নির্বাচন হোক অবাধ ও নিরপেক্ষ
    • দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন
    • বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
    • শিক্ষিত ও জবাবদিহিমূলক নেতৃত্ব
    • এবং সর্বোপরি সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা


    এগুলো অর্জন করতে কোনো “সনদ” নয়, দরকার সংবিধানের যথাযথ বাস্তবায়ন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এবং স্বচ্ছ নির্বাচন।

    বাংলাদেশের সংবিধান একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দলিল। এই সংবিধানেই রয়েছে সব সমস্যার সমাধান, যদি তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়। “জুলাই সনদ”-এর মতো অকার্যকর, অগণতান্ত্রিক ও আইনবহির্ভূত উদ্যোগগুলো শুধুই বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তৈরি।

    এটি গণতন্ত্র নয়, বরং গণতন্ত্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের একটা “soft cover” মাত্র।
    অতএব, জনগণের স্বার্থে আমাদের উচ্চকণ্ঠে বলতে হবে—
    “জুলাই সনদের কোনো প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন সংবিধানিক শাসনের পূর্ণ বাস্তবায়ন।”

    রেফারেন্স:

    1. সংবিধান, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, ১৯৭২
    2. Marbury v. Madison, 1803 (USA)
    3. Kesavananda Bharati v. State of Kerala, 1973 (India)
    4. Grundgesetz (Basic Law for the Federal Republic of Germany)
    5. The Constitution of the Fifth Republic, France, 1958
    6. Bangladesh Law Digest, 2023
    7. TIB Reports on Governance, 2024
    8. July Charter Coverage – Kaler Kantho, Daily Star, TBS News, July 2025
    9. India: Kesavananda Bharati v. State of Kerala (1973) 
    10. USA: Marbury v. Madison (1803) 

    Post a Comment

    0 Comments