আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন দেড় বছরের মধ্যে হয়, সেজন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থনের অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করে সম্প্রতি একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে বক্তব্য দিয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তার এই বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। গতকাল বুধবার কালবেলার সঙ্গে আলাপকালে এ নেতাদের বেশিরভাগই জানান, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো হওয়া জরুরি। তবে সব সংস্কার করার ম্যান্ডেট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেই। দু-একটি দলের নেতারা স্পষ্টভাবে মন্তব্য করতে চাননি। বরং তারা বলছেন, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন হওয়া উচিত। কেউ কেউ বলেছেন, সেনাপ্রধান যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি তার নিজের হলেও এটি সুচিন্তিত মতামত।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এরপর থেকেই এ সরকারের
মেয়াদ নিয়ে নানামুখী আলোচনা-বিশ্লেষণ চলতে থাকে। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল শুরু থেকেই মৌলিক সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়’ দেওয়ার কথা বলে আসছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী—কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদের বিদায় দেবেন। কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে, আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন।’ তবে তিনিও নির্বাচনের বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে কিছুই বলেননি। সম্প্রতি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কারের জন্য ছয়টি পৃথক কমিশন গঠন করেছে সরকার।
বিদেশি গণমাধ্যমে সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎকারের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল কথা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, তাদের (সেনাপ্রধান) বক্তব্য তারা বলছেন। আমরা তো কখনো দিনক্ষণ ঠিক করে কথা বলিনি। আমরা তো পরিষ্কারভাবে কথা বলছি যে, যৌক্তিক সময়। এই জায়গাতেই আমরা আছি।
দেড় বছর সময় যৌক্তিক কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এ বিষয়টি তো আমি বলতে পারব না। যারা সরকারে আছে তারাই বলবে। যারা কাজ করছে তারা বলবে, কখন তারা রেডি? সেটা তাদের দায়িত্ব।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, সেনাপ্রধান কী কারণে বলেছেন, সে বিষয়ে আমার জানা নেই এবং তথ্যও নেই। আমিও তার বক্তব্য গণমাধ্যমে দেখেছি। আমরা চাই, এই সরকার যত দ্রুত সম্ভব সংস্কারগুলো করে দেশের দায়িত্বভার নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে তুলে দিক। যে নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। সব সংস্কার যে তাদের দ্বারা হবে, তা সম্ভব নয়। তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ৮৩টি প্রস্তাব তুলে দিয়েছি দেশের স্বার্থে; কিন্তু সরকার খুব ধীরগতিতে চলছে। বিভিন্ন জায়গায় হাসিনার লোকজন এখনো বসে আছে। যেভাবে আমাদের ছেলেরা তথা ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছে, জীবন দিয়েছে, সেটার সার্থকতা আমরা দেখছি না। হাসিনার দোসরদের পরিবর্তন না করা পর্যন্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি কখনো বিরাজ করবে না। ১৮ মাসে নির্বাচন হওয়া সম্ভব কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে অলি আহমদ বলেন, অবশ্যই সম্ভব। তার আগেও করা সম্ভব। কারণ এই সরকারের তো সবকিছু করার ম্যান্ডেট নেই। সবকিছু সংসদে আসতে হবে, এটাই শেষ কথা।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের কালবেলাকে বলেন, আমরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। তবে গত ২৭ আগস্ট জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, নির্বাচনের জন্য যৌক্তিক সময় দিতে হবে। সংবিধান, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার দরকার। বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, সেনাপ্রধান যে বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন আমরা সেজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। কেননা বিষয়টি একটা ধোঁয়াশার মধ্যে ছিল। কিন্তু তিনি বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। আমাদের প্রত্যাশাও কিন্তু উনার কাছাকাছি। আমরা এরকমই চাচ্ছি। দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন হওয়াটা যৌক্তিক। এই সময়ের মধ্যে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করতে হবে। আমার মনে হয় সময়টা মোটামুটি ঠিক আছে। এর চেয়ে বেশি হলে আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেবে। প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো এই সময়ের মধ্যেই সম্ভব করতে হবে। বেশি সময় নিলে আরও অন্য সংকটসহ রাজনৈতিক, সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা তৈরি হবে। সুতরাং আমার মনে হয়, এই সময়টা ঠিক আছে। সেনাপ্রধান বিষয়টি যথার্থই বুঝতে পারছেন। বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান তার বক্তব্যে বললে আরও ভালো হতো। তাহলে নির্বাচন নিয়ে সংশয়টা কেটে যেত।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ১৮ মাসের বিষয়টি উল্লেখ করে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান যে মন্তব্য করেছেন, আমি মনে করি সেটি তার সুচিন্তিত মতামত। অন্যদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই উনি এসব বলেছেন। কেননা তিনি রয়টার্সকে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ হয়, কথাবার্তা কিংবা আলাপ-আলোচনা হয়। আমি মনে করি, এই যোগাযোগের প্রতিফলন হিসেবেই তিনি এই ১৮ মাসের ধারণা দিয়েছেন। তাহলে আমরা ধরে নেব, এ বিষয়ে তারা একমত। তা ছাড়া এই ১৮ মাসের কথার মধ্যে তিনি ৩টি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে এনে সংস্কার, নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর করা। সুতরাং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি সিরিয়াস হয় এবং সবাই যদি সহযোগিতা করে, সেনাবাহিনীও যদি সময় দেয় তাহলে আমি মনে করে আঠারো মাসে সেটি (নির্বাচন) সম্ভব।
0 Comments