ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক আবার নতুন করে জমে উঠেছে। তার পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে এক-এগারোর অনুঘটক এবং বেনিফিশিয়ারি হিসেবে যারা পরিচিত পেয়েছেন তারা যেমন ড. কামাল হোসেন, মির্জা আজিজুল হক, হোসেন জিল্লুর রহমান অথবা আমলা হিসেবে বিভিন্ন সরকারের আমলে সুবিধাভোগী এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টার তকমাআঁটা ড. আকবর আলী খান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ যেভাবে ড. ইউনূসের পক্ষে নেমেছেন তাতে যে-কারোই মনে হতে পারে 'ডাল মে কুছ কালা হায়।'
তাছাড়া দেশের একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিক ড. ইউনূসের মুখপত্র হিসেবে কাজ করছে বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। এই দুটি পত্রিকার ভূমিকা দেখে যে কারো এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে, ড. ইউনূস নিজে তার পক্ষে যতটা না সাফাই গাইতে পারেন, এই দুই পত্রিকা তার চেয়েও একডিগ্রি এগিয়ে থাকতে পছন্দ করে। এমন দৃষ্টিকটূ পক্ষপাতমূলক প্রচারণা চালিয়ে এই পত্রিকা দুটি কি ড. ইউনূসের মর্যাদা উঁচু করছে না-কি তার সম্পর্কে মানুষের মনে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলছে, সে প্রশ্ন করাই যেতে পারে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বড় কীর্তি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। গরিব মানুষেরও ঋণ পাওয়ার অধিকার আছে– এই ধারণাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। বলা হয়ে থাকে, ড. ইউনূস উদ্ভাবনী উপায়ে ভূমিহীন দরিদ্র নারীদের ক্ষমতায়ন করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল পৃথিবীর অনেক দেশই অনুসরণ করছে। এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি অনেক সম্মান ও মর্যাদা অর্জন করেছেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান থেকে শুরু করে রাজা-রাণীদের সঙ্গেও তিনি পরিচিতি ও ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। ড. ইউনূস এবং তার গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটা বাংলাদেশের জন্য এক 'বড়' সম্মান। অর্থনীতিতে না দিয়ে তাকে কেন শান্তিতে নোবেল দেওয়া হলো– এই প্রশ্ন তখন স্বভাবতই উঠেছিল। শান্তিতে নোবেল সব সময় কৃতিমানদের দেওয়া হয়েছে, তা নয়। মনে করা হয় পুঁজিবাদী দুনিয়ার স্বার্থরক্ষাকারী কাউকে কাউকে বিশেষ 'ইনাম' হিসেবে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়। বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও খ্যাতনামা শান্তিবাদী রাজনীতিবিদ মহাত্মা গান্ধীকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে সমরবাদী মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিনজারকে, দেওয়া হয়েছে ইজরাইলের বিতর্কিত প্রধানমন্ত্রীকে।
আরো পড়ুন: সংবিধান অনুযায়ী আগামী ৪ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন
ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে কোনো বিশেষ বিবেচনায় নোবেল পেয়েছেন কি-না সে প্রশ্ন না তুলেও বলা যায়, নোবেল পাওয়ার পর তার আচার-আচরণ অন্য নোবেল বিজয়ীদের মতো দেখা যাচ্ছে না। এই বড় পুরস্কার তাকে বিনয়ী না করে অহঙ্কারী করে তুলেছে বলেই অনেকের কাছে মনে হচ্ছে।
নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর ড. ইউনূস তার সম্মান ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হবেন না– এটাই ছিল স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। কিন্তু তিনি কী করলেন? নোবেল পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে তিনি ভাবলেন, এখন দেশের রাষ্ট্রক্ষমতাটাও তার চাই। এমন স্বপ্ন যে-কোনো নাগরিকেরই থাকতে পারে। ড. ইউনূস যেহেতু দেশে-বিদেশে যথেষ্ট পরিচিত, সেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার ইচ্ছা তার জাগতেই পারে। কিন্তু ক্ষমতায় যেতে হলে স্বাভাবিক যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সেটা অনুসরণ না করে তিনি শর্টকার্ট পথে হাঁটতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন।
বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত এক-এগারোর সময় যখন রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে (প্রকৃত পক্ষে শেখ হাসিনাকে) মাইনাস করার চক্রান্ত হয়, তখন চরম সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী নীতি অনুসরণ করে সামরিক কর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সামরিক কর্তাদের ক্রীড়নক হয়ে একজন নোবেল বিজয়ী রাজনৈতিক দল গঠন করতে নামবেন– এটা কি দেশের মানুষকে খুব উৎসাহিত করার মতো ঘটনা? হাসিনা-খালেদাকে গ্রেফতার করে রাজনীতির মাঠ ফাঁকা করে দিয়ে যারা ড. ইউনূসকে দিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চেয়েছিলেন, তারা শেষ পর্যন্ত সফল হননি। রাজনীতিতে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কড়া সমালোচক ড. ইউনূস তার ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করতে গিয়ে ডিগবাজি খেয়েছেন গোড়াতেই।
রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করা যত সহজ, রাজনীতি করা বা রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা যে ততো সহজ নয়, এটা ড. ইউনূস হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে কেটে পড়েছেন। নোবেল জয়ী হওয়ার কারণে দেশের মানুষ তাকে রাজনীতিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাগত জানায়নি। এখান থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, নোবেল পেলেই সব কিছু পাওয়ার বা হওয়ার ছাড়পত্র পাওয়া যায় না। এই যে রাজনীতিতে নামতে গিয়ে ড. ইউনূস পিছু হটলেন, সে জন্য কি কোনোভাবে শেখ হাসিনা দায়ী?
এই প্রশ্নটা এ জন্যই করা হচ্ছে যে, আজকাল তার ভক্ত-সমর্থকরা বলছেন যে, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি বর্তমান সরকারের আচরণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এক-এগারোর পর ড. ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠন করতে চেয়েছিলেন বলে বর্তমান প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রতি অখুশি। যদি তাই হয়, তবে সেটা কি খুব অন্যায্য? এক-এগারোর পর সামরিক কর্তাদের মদদে ড. ইউনূস দল গঠন করতে নামায় শেখ হাসিনার তো তার প্রতি অখুশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। শেখ হাসিনা রাজনীতি করেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। দেশে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করার কাজে যাদের ভূমিকা বড় সেই সামরিক কর্তাদের আশীর্বাদ নিয়ে ড. ইউনূস রাজনীতিতে নামতে চাইবেন আর শেখ হাসিনা তাকে অভিনন্দন জানিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করবে– এটা যারা আশা করেন, তারা আহাম্মক। দুঃখের ব্যাপার, তারা যে আহাম্মক সেটা তারা বোঝেন না বলেই তারা হাসিনার সমালোচনা করে ড. ইউনূসের প্রশংসা করেন।
ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮৩ সালে একটি সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শুরুতে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের ছিল ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং ঋণ গ্রহীতাদের ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১০ সালের হিসাবমতে গ্রামীণ ব্যাংকের সম্পদ ও সম্পত্তির পরিমাণ হচ্ছে ১২ হাজার ৫৩৯ কোটি ৬৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। এখন এর পরিমাণ হয়তো আরো বেড়েছে। নিশ্চয়ই ড. ইউনূসের শ্রম ও মেধা এই প্রতিষ্ঠানটিকে আজকের অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। দরিদ্র অসহায় নারীদের ভাগ্যোন্নয়ন বা ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের ২০ তলা একটি আলীশান ভবন হয়েছে রাজধানীর মিরপুরে, এটা কি কম বড় সাফল্য! তবে যাদের বিন্দু বিন্দু সঞ্চয়ের জামানতে গ্রামীণ ব্যাংকের তহবিল ফুলেফেঁপে উঠেছে, তাদের ভাগ্যের সত্যিকার অর্থে কতটা উন্নতি হয়েছে, সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র নারীদের দারিদ্র্যমুক্ত করে ক্ষমতায়িত করছে, না তাদের ঋণজালে বেঁধে শৃঙ্খলিত করছে– সে প্রশ্নের সহজ জবাব নেই।
ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে দেশে দেশে এত হৈচৈ, অথচ গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা এই ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কতটা উপকৃত হয়েছেন, তাদের অবস্থা ও অবস্থানের সত্যিকার অর্থে কী পরিবর্তন হয়েছে তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা আজ পর্যন্ত হয়েছে কি? ড. ইউনূস উদ্যোগী হয়ে কেন এই কাজটি করেন নি? গ্রামীণ ব্যাংকের যে লাখ লাখ সুবিধাভোগীর কথা বলা হয় তাদের ঋণ সুবিধা নেওয়ার আগে-পরের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য কি পাওয়া যায়?
ড. ইউনূসের পক্ষ নিয়ে যারা বলছেন এবং লিখছেন তাদের মূল কথা হলো, তার মতো একজন মর্যাদাবান মানুষের পেছনে লেগে সরকার বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার ড. ইউনূসের পেছনে লেগেছে, না ড. ইউনূস সরকারের পেছনে লেগেছেন? ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের বেতনভুক্ত এমডি ছিলেন। তার নিজের কোনো বিনিয়োগ নেই। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তিনি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডির দায়িত্বে ছিলেন। বিধি অনুযায়ী ৬০ বছর বয়সে তার অবসরে যাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি তা করেননি। ২০১১ সালে তার অবসরের বয়সসীমা ১১ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর তার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বছরেরই মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে এমডি পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। তাকে অব্যাহতি দেয়ার ব্যাপারটিকে একটি ইস্যুতে পরিণত করে তিনি দেশে-বিদেশে তার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যান। উচ্চ আদালতও তার পক্ষে রায় দেননি। অথচ এ নিয়ে তিনি প্রচারণা অব্যাহত রাখেন।
একজন নোবেল বিজয়ীর পক্ষে এটা কতটা সমীচীন হয়েছে সে প্রশ্ন না তুলে যারা সরকারকে দোষারোপ করছেন, তারা একদেশদর্শী, তারা বুঝতে চান না যে দেশে-বিদেশে মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন বলেই তার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়নি। নোবেল বিজয়ীর জন্য কোনো দেশে নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো আইন তৈরি করা হয় না।
ড. ইউনূস না থাকলে গ্রামীণ ব্যাংক ধ্বংস হয়ে যাবে বলে যারা চিৎকার করছেন তাদের বালখিল্যপনা দেখে করুণা হয়। ড. ইউনূস কেমন ব্যবস্থাপক যিনি দুই যুগ ধরে একটি প্রতিষ্ঠান চালালেন, অথচ তার কোনো বিকল্প তৈরি করলেন না? কর্তৃত্ব কুক্ষিগত করে রাখা কি সৎগুণের মধ্যে পড়ে? তিনি তো অমরত্ব নিয়ে পৃথিবীতে আসেননি, জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী তাকে একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে, সেদিন তাহলে কী হবে? ড. মুহম্মদ ইব্রাহিমের প্রতিষ্ঠিত বারডেম হাসপাতাল কী তার মৃত্যুর পর ভালোভাবে চলছে না? প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসাসেবা লাভ করছেন। এই প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে সরকার কি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে?
গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ড. ইউনূসের এত শঙ্কা কেন? তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বলেই তাকে আমৃত্যু গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে রাখতে হবে? ওটা তো একটি চাকরি। চাকরির বয়সমীমা তিনি মানবেন না? এটা হয় কখনো, কোনো দেশে?
পশ্চিমা দুনিয়ায় ড. ইউনূসের এত কদর কেন– এই প্রশ্ন করায় একজন সমাজ সচেতন আমার অনুজপ্রতীম এক বন্ধু কৌতূহলোদ্দীপক এক ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, পশ্চিমা তথা পুঁজিবাদী দুনিয়া ড. ইউনূসের কাছে কৃতজ্ঞ এ কারণে যে তিনি এমন একটি পন্থা উদ্ভাবন করেছেন যার মাধ্যমে হতদরিদ্র মানুষকেও শোষণ করা যাচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে যাদের কিছুই নেই, যারা একেবারেই সহায় সম্বলহীন, তাদেরও শোষণের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। আগে এটা সম্ভব ছিল না। তাদের রিলিফ দেওয়া ছাড়া তাদের কাছ থেকে পাওয়ার কিছু ছিল না। ইউরোপ-আমেরিকার কোন অর্থনীতিবিদ-গবেষক-পণ্ডিত শোষণের এ ধরনের অভিনব পদ্ধতির কথা ভাবতে পারেননি।
ড. ইউনূস গরিবকে তার অবস্থা পরিবর্তনের জন্য সহায়তার নামে অল্প সামান্য টাকা ঋণ দিয়ে তা থেকে মাত্রাতিরিক্ত সুদ নিয়ে অবিরাম শোষণের যে প্রক্রিয়া চালু করেছেন তাতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষকরা তাজ্জব বনে গেছেন বলেই ড. ইউনূসকে নিয়ে তাদের এত মাতামাতি। এই ব্যাখ্যাটি কি তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেওয়ার মতো?
গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের কাছ থেকে জামানত গ্রহণ, ঋণদান প্রক্রিয়া, সুদের হার ইত্যাদি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এটা এক মারাত্মক দুষ্টচক্র। এর মধ্যে একবার ঢুকলে বের হওয়া কঠিন। গ্রামীণ ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। গ্রামীণ ব্যাংকের অভ্যন্তরে অনিয়ম-অব্যবস্থার অভিযোগও নতুন নয়। ড. ইউনূস যদি তার সম্মানের দিকটি নিজে থেকে বিবেচনায় নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করতেন, তাহলে সেটাই হতো উত্তম।
কিন্তু অনিয়ম দূর করার জন্য নিজে তো উদ্যোগ নেননি, উল্টো সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করায় তিনি তাতে বাগড়া দিচ্ছেন। বিদেশি মুরুব্বিদের শরণাপন্ন হয়ে সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছেন অনিয়ম-অব্যবস্থা নিয়ে তদন্ত বন্ধ করার জন্য। সরকারি পদক্ষেপের কারণে যদি সত্যি গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে এর সুবিধাভোগীরাই তো প্রথম প্রতিবাদ করবে। ড. ইউনূস আগ বাড়িয়ে কেন বাধা দিচ্ছেন?
বলা হয়ে থাকে, ৮৪ লাখ ঋণগ্রহীতা গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার এবং তারাই ব্যাংকটির মালিক। প্রশ্ন হচ্ছে, এই শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ট বা লভ্যাংশ দেওয়া হয় কি? যতদূর জানা যায়, কাউকেই কোনো লভ্যাংশ দেওয়া হয় না। তারা নামমাত্র মালিক। ব্যাংকের সুযোগ-সুবিধা সবই ড. ইউনূস ভোগ করেন। যুগ্ম সচিবের পদমর্যাদায় এমডি পদে চাকরি করে তিনি কত সম্পদের মালিক হয়েছেন, তার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে কত টাকা আছে, এই টাকা তিনি কী ভাবে আয় করেছেন, এর জন্য আয়কর দিয়েছেন কি-না সে সব জানার অধিকার যেমন এই ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের আছে, তেমনি আছে সরকারেরও। গ্রামীণ ব্যাংকের সুনাম ব্যবহার করে গ্রামীণ নামের যে অসংখ্য (৫৪টি) কোম্পানি গড়ে তুলেছেন সে সবের টাকা কোথা থেকে এসেছে, এগুলোর প্রকৃত মালিক কারা তা জানতে চাওয়া সরকারের অপরাধ হতে পারে না। কোনো কোনো পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞ এমন উদ্ভট কথাও বলছেন যে, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তদন্তে আপত্তি ছিল না, যদি তা উদ্দেশ্যমূলক না হতো। সরকার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এসব করছে।
সরকার অনিয়ম-অব্যবস্থা তদন্ত করতে চাইছে 'অসৎ' উদ্দেশ্য নিয়ে আর ড. ইউনূস অনিয়ম-অব্যবস্থা করেছেন 'সৎ' উদ্দেশ্য নিয়ে? এ-সব যারা বলেন এবং বিশ্বাস করেন, তারা জ্ঞানপাপী, এদের থেকে সাবধান থাকাই ভালো।
0 Comments